ভাষা কাকে বলে? ভাষার প্রকারভেদ, ভাষার বৈশিষ্ট্য ও ভাষার প্রয়োজনীয়তা

 ভাষা কাকে বলে? ভাষার প্রকারভেদ ভাষার বৈশিষ্ট্য ও ভাষার প্রয়োজনীয়তা
ভাষা কাকে বলে? ভাষার বৈশিষ্ট্য ও ভাষার প্রয়োজনীয়তা

ভাষার সংজ্ঞা

”মনোভাব প্রকাশের জন্য মানুষ বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে সুকৌশলে অর্থবহ যে ধ্বনি বা ধ্বনি-সমষ্টি উচ্চারণ করে তাকে ভাষা বলে”। অর্থাৎ, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বা্যেন্ত্রের সাহায্যে মানুষ কৌশলে যে ধ্বনি উচ্চারণ করে তা দিয়ে যেসব অর্থযুক্ত শব্দ বাক্য রচনা করা হয় তাকে ভাষা বলে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা

  •  ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনি সকল দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে তার নাম ভাষা।”
  •  ড. মুহম্মদ এনামুল হকের ভাষায়, “মানুষ তার মনোভাব প্রকাশ করার জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে অপরের কাছে যে ধ্বনি-সমষ্টি উচ্চারণ করে থাকে, সেই ধ্বনি বা ধ্বনি –সমষ্টিকে ভাষা বলা হয়।”
  •  ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মনোভাব ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ-সমষ্টিকে ভাষা বলে।”
  •  ড. সুকুমার সেনের মতে, ”মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি-সমষ্টিই ভাষা।”

সাধু, চলিত, আঞ্চলিক, প্রমিত এবং উপভাষার উদাহরণসহ সংজ্ঞা লিখুন।

 সাধু ভাষাঃ যে ভাষা প্রধানত তৎসম শব্দবহুল সর্বনাম ক্রিয়াপদসমূহ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, কিছুটা গুরুগম্ভীর কৃত্রিম তাকেই সাধু ভাষা বলে। যেমন- ‘জানিবার বুঝিবার প্রবৃত্তি মানুষের মন হইতে যেই দিন চলিয়া যাইবে সেই দিন মানুষ পুনরায় পশুত্ব লাভ করিবে।

 চলিত ভাষাঃ ভাগীরথী-তীরবর্তী জনপদের ভদ্র শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা পরিমার্জিত হয়ে সাহিত্যে যেভাবে স্থান পেয়েছে তাকেই চলিত ভাষা বলে। যেমন- ‘জানবার বুঝবার

প্রবণতা মানুষের মন থেকে যেদিন চলে যাবে সেদিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে।

 আঞ্চলিক ভাষাঃ বাংলায় লেখ্য ভাষার নির্দিষ্ট একটা রুপ আছে, কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের মুখের ভাষার সেরকম কোনো নির্দিষ্ট কোনো রুপ নেই। বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলে মুখের ভাষার যে

ভিন্ন ভিন্ন রুপ দেখা যায়, তাকে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। যেমন- কোনো এক ব্যক্তির দুই পুত্র ছিল।

নোয়াখালীঃ একজন মাইনসের দুগা হোলা আছিল।

ময়মনসিংহঃ এক জনের দুই পুৎ আছিল।

 প্রমিত ভাষাঃ একই ভাষার উপভাষাগুলো অনেক সময় বোধগম্য হয় না। এজন্য একটি উপভাষাকে আদর্শ ধরে সকলের বোধগম্য ভাষা হিসেবে তৈরি ভাষারুপই হলো প্রমিত ভাষা। যেমন-

অমিত যেখানে সেখানে হো হো করে বেড়াচ্ছে __ ফিরপোর দোকানে যাকে তাকে চা খাওয়াচ্ছে, যখন তখন মোটরে চড়িয়ে বন্ধুদের অনাবশ্যক ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে।

 উপভাষাঃ আঞ্চলিক ভাষা কেই উপভাষা বলা হয়।

ভাষার বৈশিষ্ট্য

ভাষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় মানুষের দৈনন্দিন পারিবারিক, সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ। ভাষার সংজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো বৈশিষ্ট পাওয়া যায়। ভাষার প্রধান বৈশিষ্টগুলো নিম্নরূপ:

  •  মানুষের বাগযন্ত্রের উচ্চারিত ধ্বনি-সমষ্টি দ্বারা ভাষা গঠিত। বাগযন্ত্র ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সৃষ্ট ধ্বনি ভাষা সৃষ্টি করতে পারে না।
  •  উচ্চারিত ধ্বনি-সমষ্টি অবশ্যই অর্থ প্রকাশক হতে হবে।
  •  উচ্চারিত ধ্বনি বা শব্দ শোনা না গেলে তা  ভাষা হিসেবে গণ্য হয় না।
  •  ভাষা একই এলাকার বহুজনবোধ্য এবং পরিবর্তনশীলঅ
  •  ভাষা পরস্পরের মাঝে যোগাযোগ সৃষ্টি করে ও ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে বা সেতুবন্ধন রুপে কাজ করে।
  •  ভাষা একটি সামাজিক প্রতিষ্টান, যা তার নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম।
  •  ভাষা যতই কঠিন শব্দ দিয়েই শুরু হোক না কেন, মানুষের ব্যবহারের ফলে ক্রমে ক্রমে এসে তা সহজ ও সরল হয়ে ওঠে।
  •  মানুষের মুখে ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষা স্থায়িত্ব লাভ করে।
  • ভাষার দুটি প্রধান রুপ থাকে। লিখিত আর কথ্য। লিখিত অবস্থা ভাষার স্থায়ী রূপ হলেও ভাষার প্রকৃত অবয়ব ফুটে ওঠে কথ্য ভাষার মধ্যে। সুতরাং দেখা যায়, প্রতিটি ভাষারই তিনটি অংশ থাকে। যথা: ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্য।

ভাষার প্রয়োজনীয়তা

ভাষা শেখার প্রধান মাধ্যম হলো পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ধরা যাক, একটি মানবশিশু জন্মগ্রহণ করল। জন্মের পর তাকে বনে রেখে আসা হলো। বনেই সে বড় হলো। তার কথা বলার মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকলেও সে কথা বলতে পারবে না। কারণ, তাকে ভাষা রপ্ত করতে হলে অনেক মানুষের সাথে জীবন কাটাতে হবে। তাকে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হবে। ভাষা ব্যাপারটি এমন যে, সমাজের মধ্যেই কেবল তা দেখা দিতে পারে এবং একসঙ্গে বসবাসকারী অনেক প্রাণীর মধ্যে এর ব্যবহার সম্ভব। মানব সমাজে বসবাস করতে হলে এবং তার মনোভাব প্রকাশ করতে হলে ভাষা জানা প্রয়োজন। সমাজ ছাড়া ভাষার কোনো প্রয়োজন নেই। বিচ্ছিন্ন একটি মানুষের কোনো ভাষা না হলেও চলে।

মাতৃভাষা

মানবশিশু প্রথমে ভূমিষ্ট হয়েই মায়ের কোলে থাকে। সবকিছুতেই শিশুটি মাকে অনুসরণ করে। মা যা যা করে, যা যা বলে শিশুও তাই অনুসরণ করে এবং বলে। এভাবেই সে মায়ের মুখ থেকে নিঃসৃত ধ্বনি বা ধ্বনি-সমষ্টি শুনে শুনে ভাষা আয়ত্ত করে। শিশু মায়ের হাতে হাতে খেতে, হাসতে হাসতে, ঘুমাতে তথা সর্বাবস্থায় মায়ের মুখ থেকে ভাষা শেখে। তাই মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষাকেই বলা হয় মাতৃভাষা। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এদেশেই আমাদের জন্ম। আমাদের এই বাংলা ভাষাটিকে আমরা মায়ের কোল থেকেই শিখেছি। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ইংরেজরা ইংরেজি ভাষায় কথঅ বলে তাই তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। তেমনি জাপানিরা জাপানিজ ভাষায়, ফরাসিরা ফরাসি ভাষায়, পারস্যের অধিবাসীরা ফারসি ভাষায়, পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষায়, আরবীয়রা আরবি ভাষায় কথা বলে।

Previous Post Next Post