রচনা এইডস এক মরণব্যাধি

রচনা এইডস এক মরণব্যাধি
রচনা এইডস এক মরণব্যাধি

ভূমিকা: ধর্ম থেকে বিচ্যুত মানুষের কল্যাণ নেই। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন যেখানে নীতি বিসর্জনের জন্য নির্ধারণ কোনো দন্ড, সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে নীতিবান হতে প্ররোচিত করে। পারলৌকিক শাস্তির বিধান রেখে ধর্ম মানুষের লাগামহীন জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। তবুও কোনো কোনো মানুষ যখন ধর্মের তোয়াক্কা না করে বল্লাহীন ভোগবিলাস মেতে ওঠে, হয়ে ওঠে ধর্মনিষিদ্ধ ব্যভিচারের(যেনা) একনিষ্ঠ পূজরি, তখনই ব্যভিচারি মানুষের ওপর নেমে আসে বিধাতার অভিশাপ-ও এইডস। এইডস যেন মানব সভ্যতারই এক জীবন অভিশাপ। সমকামিতা, বহুগামিতাসহ আরো কিছু কারণে উদ্ভূত এ রোগের একমাত্র ও নিশ্চিত পরিণতি মৃত্যু। প্রখ্যাত রক তারকা’হাডসন’ এ রোগে মারা গেলে রোগটি সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানতে শুরু করে। তবুও প্রতি বছর সচেতনতা ও সুষ্ঠ জ্ঞানের অভাবে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এ রোগে।

এ আমার, এ রোগ তোমার পাপ,

এ বিধাতার অভিশাপ।

                          -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এইডস-পরিচয়: এইডস হচ্ছে ভাইরাসজনিত একটি রোগ। এ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও ক্ষুদ্র আকৃতির হয়ে থাকে যে কারনে সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে না। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচআইভি বা হিউম্যিান ইম্যুন ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। এই রোগের পূর্ণনাম একোয়ার্ড ইম্যুন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম(Acquired immune deficiency syndrome)। বা সংক্ষেপে AIDS; এইচ আই ভি(HIB) শরীরে প্রবেশ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আস্তে আস্তে লোপ পায়। এই রোগের জীবাণু মানব দেহের রক্ত প্রণালীতে মিশে যায়। কিছুকাল সুপ্ত থাকে, তারপর ধীরে ধীরে দেহে নানা উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায়।

এইডস-এর বিস্তার: এইডস প্রধানত যৌন অনাচারের জন্যই হয়। এ রোগের বিস্তার কিভাবে ঘটে এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন। সাধারণত এইডস রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে অবাধ যৌন মিলনের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত যারা শিরায় ইনজেকশন নিয়ে নেশা করে তাদের এ রোগ হতে পারে। এছাড়া যাদের রক্ত গ্রহণ করতে হয় তাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। দাতার রক্তে এইডস জীবাণু থাকলে গ্রহীতারও এ রোগ হবে। যেমন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই রক্ত নিতে হয় অথবা রক্ত থেকে তৈরি ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। এইডসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এদেরও রয়েছে। পাশ্চাত্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানুষেরা বেপরোয়া যৌন জীবনে অভ্যস্ত। নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন  সেখানে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত। এসব দেশে বহুগামিতা ও সমকামিতা, পশুমৈথুন প্রায় সমাজস্বীকৃত    ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে এইডসে আক্রান্তদের মধ্যে সমকামী ও মাদকসেবীদের সংখ্যা বেশী। সিফিলিস ও গনোরিয়া যৌনব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এইডসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। আসল কথা যৌন অনাচারই এসব দেশে এইডস মহামারীর জন্ম দিয়েছে।

এইডস এর জন্মের ইতিহাস: বিজ্ঞানীরিা এইডস রোগের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। তাঁদের ধারণা এই রোগ প্রথমে আফ্রিকা মাদেশে দেখা গিয়েছে। মার্কিন গবেষকরা এই রোগের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে আফ্রিকার বহু দেশে গিয়েছেন। অধিকাংশ গবেষকদের মতে, এইডস একটি নতুন রোগ। এইডসের উৎপত্তি এক জাতের বানর থেকে হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ জাতীয় সবুজ বানরদের মাঝে এইডস রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে।

 

এইডসের প্রতিরোধ চিকিৎসা: এইডস রোগ হওয়ার পর থেকেই অপ্রতিরোধ্যভাবে বিস্তার লাভ করে চলেছে। এই রোগ বিস্তারের প্রতিরোধ আজও পর্যন্ত করা হয়নি। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে প্রতিরোধ বহু ব্যয়সাপেক্ষ গবেষণা হচ্ছে; কিন্তু সাফল্য অর্জিত হয়নি। এইডস চিকিৎসার কোনো কার্যকরী ঔষধ বা কোনো প্রতিষেধক নেই। তবে এ রোগের চিকিৎসায় আই সো প্রিনোসিন নামক এক ধরনের বিতর্কিত ঔষধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ওষুধ আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের মাত্রা কমাতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এ. জেড. টি. নামক একটি ওষুধ অনুমোদন করেছে।

প্রতিকার: এইডসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে- (১) প্রথমেই অবাধ ও যৌন সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। (২) সমকামিতা ও পতিতালয়ে গমন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। (৩) পুরুষদের বহু নারীতে ও নারীদের বহুপুরুষ গমন বন্ধ করতে হবে। (৪) যৌন মিলনের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে পুরুষকে কনডম ব্যবহার করতে হবে। (৫) সমাজ জীবনে নৈতিক আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। (৬) যারা অন্যের রক্ত গ্রহণ করবেন তা এইডস-ভাইরাসমুক্ত কিনা সে বিষয়ে পূর্ব থেকেই সচেতন হতে হবে। একজনের ব্যবহৃত সিরিন্জ অন্যের শরীরে ব্যবহার করা যাবে না। (৭) ইতিমধ্যেই যারা এইডসে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের শরীরে এইডস জীবাণু আছে তাদের সংযমী হতে হবে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির অন্যের সাথে যৌন সম্পর্ক করা উচিত হবে না। (৮) এইডসে আক্রান্ত বাবা-মায়ের সন্তানরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে এইডসে আক্রান্ত দম্পতিদের সন্তানধারণ থেকে  বিরত থাকতে হবে। (৯) এইডস কোনো সংক্রামক রোগ নয়। অবাধ যৌন সম্পর্ক ও শিরাপথে রক্ত বা মাদক  দ্রব্য ব্যবহারকারীদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং অনিরাপদ যৌন জীবন ও মাদক দ্রব্য পরিহার করে এইডসের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

এইডসের লক্ষণ: এইডস রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ রোগের জীবাণু দীর্ঘকাল সুপ্ত থাকতে পারে। এইডসের লক্ষণ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পরে দেখা দিতে শুরূ করে। প্রথমে রোগাকান্ত্র ব্যক্তির হজমে গোলমাল দেখা দেয়। অসম্ভব রকমের পাতলা পায়খানা হতে থাকে। দ্রুত ওজন হৃাস পায় এবং দীর্ঘদিন একটানা জ্বর ও খুশখুশে কাশি  থাকে। এ সমস্তই এইডসের প্রাথমিক লক্ষণ। পরবর্তীকালে মুখে  ঘা হয়  এবং শরীরের নানা অংশের গ্রন্থিগুলো ফুলে যায়। শরীরে ব্যাপকভাবে চুলকানি দেখা দিতে পারে।

এইডস রোগের ফলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে য়ায়। এর ফলে দেহে যেসব উপসর্গ সৃষ্টি হয়, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগ করেও সেসব নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

উপমহাদেশে এইডস: আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এইডসের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের মুম্বাই, দিল্লী ও চেন্নাইতে অসামাজিক কারযকলাপ যেমন বেশি হয় তেমনি পতিতালয়ের সংখ্যাও বেশি। এসব পতিতালয়ে দেশি-বিদেশি লোক গমন করে থাকে। ভারতের চিকিৎসক দলের একটি  সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, পতিতাদের অনেকেই এইডসে আক্রান্ত।

বাংলাদেশেও এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ব্যাপক। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য(২০১২) অনুযায়ী ২৮৭১ জন ব্যক্তি HIB-তে সংক্রমিত হয়েছে। মোট ১২০৪ জন AIDS-এর রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। AIDS-এ মৃত্যু ঘটেছে মোট ৩৯০ জনের। অভিবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে এই সংক্রমণের হার বেশী হয়। এজন্য আমাদের দেশে এইডস প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছে। যারা বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে দেশত্যাগ করে বা প্রবাসী সে সমস্ত লোক দেশে ফিরে তাদের ভালোমতো পরীক্ষা না করে বিমান বন্দর হতে ছাড়পত্র প্রদান করা উচিত হবে না। এদেশে পর্যটন ও নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যে সমস্ত বিদেশির আগমন ঘটে তাদের উপযুক্ত পরীক্ষা ব্যতিরেকে দেশে গ্রহণ করা উচিত নয়। আমাদের দেশে রক্ত হতে তৈরি ওষুধগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ সমস্ত ওষুধের লেবেলে এইডসমুক্ত কথা লেখা থকাই যথেষ্ঠ বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। এ দেশের ল্যাবরেটরিতে ওষুধ গুণাগুণ পরীক্ষা করে নিতে হবে। হেরোইনসহ অন্যান্য ড্রাগের অবৈধ ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ। এ দেশে এইডসের মতো ভয়াবহ রোগের  গবেষণা ও চিকিৎসা সম্ভব নয়। সুতরাং কঠোর সংযমের মধ্য দিয়েই আমাদের এইডসের মতো রোগকে প্রতিরোধ করতে হবে।

উপসংহার: সুতরাং অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও সারাবিশ্বে এইডস-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে গেছে। কিন্তু এটাই সবচেয়ে সান্ত্বনার ব্যাপারে যে, এ রোগের কারণ মানুষের অজানা নয়। মানুষ ইচ্ছে করলেই এ রোগকে প্রতিরোধ করতে পারে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মধ্য দিয়ে অধিকতর সংযমী হয়ে। ইসলাম ধর্মে ব্যভিচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। এমনকি অতীতে যৌন অনাচারের পাপে আল্লাহর পাপে অভিশাপে ধ্বংস হয়েছে আদ ও সামুদ জাতি। সুতরাং ধর্মের পথই কল্যাণের পথ, শান্তির পথ। এ পথেই এইডস-এর মতো ভয়াবহ রোগের হাত থেকে প্রকৃত উত্তরণ সম্ভব। 

Post a Comment

Pllease wait a moment

Previous Post Next Post